ধুঁকে ধুঁকে চলা লোকসানি প্রতিষ্ঠান টেলিটক চীন থেকে কঠিন শর্তে ঋণ নিচ্ছে। এই ঋণের আওতায় সব ধরনের পণ্য চীন থেকেই কিনতে বাধ্য টেলিটক। ফলে বেশি দামে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি দিয়েই নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কাজ করতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
টেলিটক জন্মাবধি রুগ্ণ এবং সব সরকারের সময়ই প্রতিষ্ঠানটির কেনাকাটা নিয়ে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আর এখন সরকারি মালিকানার এই মোবাইল ফোন কোম্পানিটি নতুন করে চীন থেকে ২১ কোটি ১০ লাখ ডলার বা প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে চীনে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়েছে। এ সময় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু এবং সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। চুক্তি অনুযায়ী, টেলিটক ঋণ নেবে চায়না এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে। আর যন্ত্রপাতি কেনা হবে চীনের হুয়াওয়ির কাছ থেকে। তবে যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী ঠিকাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে চীনা ন্যাশনাল মেশিনারি অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিইএমসি)।
জানা গেছে, চীন থেকে নেওয়া হচ্ছে সরবরাহকারী ঋণ। এর আওতায় পণ্য সরবরাহের কাজটি করা হচ্ছে কোনো ধরনের দরপত্র আহ্বান ছাড়াই। আবার ঋণচুক্তির আগেই এ জন্য বাণিজ্যিক চুক্তি করার শর্ত দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সবকিছুই করা হচ্ছে চীনের শর্ত অনুযায়ী। অথচ যে যন্ত্রপাতি এক হাজার ৫০০ কোটি টাকায় কেনা হচ্ছে, আরেকটি কোম্পানি চীন থেকে একই যন্ত্রপাতি মাত্র সাড়ে ১২ কোটি ডলার বা ৮৭৫ কোটি টাকায় সরবরাহ করার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি আমলেই নিচ্ছে না টেলিটক। তাদের অজুহাত হচ্ছে, ইতিমধ্যে চীনের সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেছে। অর্থাৎ ৬০০ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ মূল্যে যন্ত্রপাতি কিনতে বাধ্য হচ্ছে টেলিটক।
সূত্র জানায়, বিগত বিএনপি সরকারের সময় এই ঋণটির কাজ শুরু হয়েছিল। তবে সে সময়ের মূল প্রস্তাবে ৫০ শতাংশ পণ্য চীনের বাইরে থেকে কেনা এবং চীনা ঠিকাদারদের মধ্যে দরপত্র আহ্বানের সুযোগ ছিল। আর ঋণটি নেওয়ার কথা ছিল টিঅ্যান্ডটি বোর্ডের (বর্তমানে বিটিসিএল) জন্য। কিন্তু সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর শর্ত কঠিন হওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ বাড়ল। কেননা এখন সব পণ্য চীন থেকেই কিনতে হবে এবং কে সরবরাহ করবে সেটি চীনই ঠিক করে দেবে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব সুনীল কান্তি বোস এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্কিং যন্ত্রাংশ কিনতে চীন থেকে ২১ কোটি ১০ লাখ ডলার (প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা) ঋণ নেওয়া হচ্ছে।
এ ঋণ নেওয়ার কারণে বাধ্যতামূলকভাবে চীনের নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানির যন্ত্রপাতি বেশি দামে কিনতে হবে—এ অভিযোগের জবাবে সচিব বলেন, ‘সব দেশের চুক্তির নিয়ম কখনো এক হয় না। আর চীন কখনো আমাদের বা টেলিটককে জোর করে ঋণ দিতে চায়নি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, ইআরডি, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের প্রায় সব বিভাগ মিলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবর রহমান এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।
শুরু সেই আওয়ামী লীগ সরকার থেকেই: রুগ্ণ প্রতিষ্ঠান টেলিটকের জন্য এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে এই ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন ও যৌক্তিকতা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। ঋণটি পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কার একই ব্যাংকের কাছ থেকে ৫৮টি জেলা সদরে ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ স্থাপন প্রকল্পের জন্য নেওয়া ২২ কোটি ২০ লাখ ডলার ঋণেরই ধারাবাহিকতা।
এর পর বিগত বিএনপি সরকারও চীনা এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে আবারও ঋণ নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। ২১ কোটি ১০ লাখ ডলার ঋণে সারা দেশে পাঁচ লাখ ডিজিটাল টেলিফোন স্থাপনের জন্য ২০০৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গেও চুক্তি হয়। চুক্তিতে বলা ছিল, প্রকল্পের ৫০ শতাংশ পণ্য ও সেবা চীনের বাইরে থেকে নেওয়া যাবে এবং চীনা কোম্পানিগুলোর মধ্যে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতির অভিযোগে ওই ঋণচুক্তি বাস্তবায়ন করেনি। আর সেই বিএনপি সরকারের সময় অবাস্তবায়িত খানিকটা নমনীয় শর্তের ২১ কোটি ১০ লাখ ডলারের ‘বায়ার্স ক্রেডিট’ (ক্রেতা-ঋণ) ঋণকেই এবার ‘প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট’ (অগ্রাধিকারমূলক ক্রেতা-ঋণ) নাম দিয়ে কঠিন শর্তের ঋণে পরিণত করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১৯৯৮ সালে ৫৮টি জেলা সদরে ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ স্থাপনের জন্য চীনা কোম্পানি সিএমইসির সঙ্গে সরবরাহকারী ঋণচুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ২০০১ সালের ১৯ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণে ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তোলেন। ২০০২ সালের ২৮ মার্চ রমনা থানায় দায়ের করা মামলায় (নং-১০৩) সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মো. নাসিম এবং অর্থমন্ত্রী এস এ এম এস কিবরিয়া ছাড়াও বিটিটিবির ১১ জন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছিল।
জানা গেছে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপির সময় করা চুক্তি বাস্তবায়ন না করলেও সেটিই এখন নেওয়া হচ্ছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেই অব্যবহূত ওই ঋণ নিয়ে টেলিটকের থ্রি-জি প্রযুক্তি চালু ও ২ দশমিক ৫-জি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের তৎপরতা শুরু করে। প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার এ উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনায় সরকারকে দিতে হবে প্রায় ৪৩৩ কোটি টাকা। বাকি এক হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা (২১ কোটি ১০ লাখ ডলার) চীন সরকারের অগ্রাধিকারমূলক ‘বায়ার্স ক্রেডিট’ থেকে নেওয়া হবে।
অসত্য তথ্য দিয়েই এই ঋণ অনুমোদন নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় জানানো হয়, অতীতের অবস্থা যা-ই থাকুক না কেন, সম্প্রতি টেলিটকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে এবং উন্নতির ধারা অব্যাহত রয়েছে।
৬০০ কোটি টাকা বেশি: এদিকে, বিশ্বখ্যাত টেলিফোন যন্ত্রপাতি নির্মাতা এরিকসন তাদের চীনা কারখানা থেকে মাত্র সাড়ে ১২ কোটি ডলারে (৮৭৫ কোটি টাকা) একই যন্ত্রপাতি সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে। গত ২৭ অক্টোবর ও ৯ নভেম্বর টেলিটক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে লেখা চিঠিতে এক প্রস্তাবে প্রয়োজনে নমনীয় সুইডিশ ঋণেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে অর্ধেক দামে একই যন্ত্রপাতি কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি টেলিটক কর্তৃপক্ষ।
ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব সুনীল কান্তি বোস এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি বা সব ধরনের সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়ার পর কেউ কোনো ধরনের প্রস্তাব দিলে সেটা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হবে। চুক্তির পর অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা চুক্তির বরখেলাপ হবে।
বেহাল দশায় টেলিটক: সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপিত টেলিটকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমানে এক হাজার ২৫টি বিটিএসসহ কোম্পানির সংযোগ ক্ষমতা ১৪ লাখ ৫০ হাজার। টেলিটকের দাবি, তাদের গ্রাহকসংখ্যা ১২ লাখ। আগামী জুনে কোম্পানির মোট গ্রাহক ক্ষমতা ২৮ লাখ ৫০ হাজারে উন্নীত হবে। এ জন্য একটি প্রকল্প বর্তমানে চালু রয়েছে। এই ধারণ ক্ষমতা পূর্ণ হওয়ার অনেক আগেই নতুন ৫৫ লাখ গ্রাহক সংযোগের জন্য এখন নেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কঠিন শর্তের ঋণ।
অনেক সম্ভাবনার কথা বলা হলেও ২০০৫ সালের ৩১ মার্চ বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর পর থেকে টেলিটক এখনো লাভের মুখে দেখেনি। নিরীক্ষিত হিসাব থেকে দেখা যায়, ২০০৫ সালে ৪২ কোটি টাকা, ২০০৬ সালে ১৪ কোটি, ২০০৭ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ে ৬৬১ কোটি টাকা, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ১৬৩ কোটি টাকা এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১১০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে টেলিটক। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিটিআরসিকে ১৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা পরিশোধ দেখানো হলেও টেলিটক ওই অর্থবছরে প্রায় তিন কোটি টাকা পরিশোধ করেনি, যা বিটিআরসির নিরীক্ষিত হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। ফলে ওই টাকা যোগ হলে ওই অর্থবছরের লোকসান ২২ কোটি টাকায় দাঁড়াবে। এনবিআরের বিপুল পরিমাণ পাওনাও দীর্ঘদিনে শোধ দেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, চীনা ঋণ নেওয়ার জন্য টেলিটককে লাভজনক দেখাতে ২০০৯-১০ অর্থবছরের অনিরীক্ষিত হিসাবে ছয় কোটি ৭৭ লাখ টাকা লাভ দেখানো হয়েছে। অথচ ওই অর্থবছরে টেলিটক বিটিআরসিকে বার্ষিক লাইসেন্স ফির পাঁচ কোটি এবং রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের ১২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। আইন অনুযায়ী এ কারণে টেলিটকের লাইসেন্স বাতিল হওয়ার কথা। মোবাইল টেলিফোনের লাইসেন্সের শর্তানুযায়ী অর্জিত রাজস্বের সাড়ে পাঁচ শতাংশ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বিটিআরসিকে ২০০৯ সালের মার্চের পর থেকে আর দেয়নি। এমনকি ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরের টেলিটক লাইসেন্স নবায়ন ফি দেয়নি।
একদিকে, টেলিটকের গ্রাহক দিন দিন কমছে। টিকে থাকতে পারছে না প্রতিযোগিতায়। রয়েছে নানা ধরনের স্বজনপ্রীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি। টেলিটকের সব ধরনের সম্ভাবনা যখন নষ্ট হওয়ার পথে, ঠিক তখন চীন থেকে কঠিন শর্তে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে টেলিটককে ঋণের ভারে জর্জরিত করা হচ্ছে। এতে আর্থিক দায় বৃদ্ধি ও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি ছাড়া তেমন কিছু হবে না বলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।

সুত্র :: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-03-11/news/137618

- Copyright © 2013 telecom bd - Metrominimalist - Powered by Blogger - Designed by Johanes Djogan | Distributed by Rocking Templates -