বিপাকে কিউবি ও বাংলালায়ন দেশে তারবিহীন ইন্টারনেট ব্যবসায় প্রতিযোগিতা বাড়ছে। ফিক্সড ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তি নিয়ে ব্যবসার জন্য তৈরি হচ্ছে দেশী-বিদেশী কোম্পানি। অপেক্ষাকৃত কম বিনিয়োগে তারা বাজার দখলের পরিকল্পনা করছে। আর শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসা হারানোর ভয়ে শঙ্কিত বাংলালায়ন ও কিউবি। যদিও বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) এ শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছে। তার পরও এর বিরোধিতা করছে প্রতিষ্ঠান দুটি। সম্প্রতি বাংলালায়ন ও কিউবি এ ব্যাপারে লিখিত ও মৌখিকভাবে বিটিআরসিকে তাদের আপত্তি জানিয়েছে।
বাংলালায়ন ও কিউবি মনে করছে, রাশিয়ার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান মাল্টিনেট গ্রুপের ‘ওলো’ যেভাবে আগ্রাসী বিপণন করছে, তাতে তাদের পক্ষে বাজারে টিকে থাকা কঠিন হবে। বাজার দখল করতে তারা লোকসানে আকর্ষণীয় অফার দিতে পারে। আর এ সুযোগ লুফে নেবে সাধারণ গ্রাহক।
এদিকে বাজারে কম দামে অনলাইন সুবিধা পাওয়ার জন্য এবং সুষম প্রতিযোগিতা সৃষ্টির জন্য ফিক্সড ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রযুক্তিবিদরা। তারা বলছেন, মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করায় গ্রাহকরা নিয়মিত ঠকছে। তারা উন্নত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু আরও বেশি কোম্পানি ব্যবসা শুরু করলে অবশ্যই সেবার মান বাড়বে এবং খরচ কম হবে।
এ বিষয়ে বাংলালায়নের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) আবদুল মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে প্রক্রিয়ায় ফিক্সড ওয়াইম্যাক্সের নামে আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছে, তা সম্পূর্ণ বেআইনি। প্রথমত, প্রতিষ্ঠানগুলো ফিক্সড ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তি হওয়া সত্ত্বেও মোবাইল ওয়াইম্যাক্সের প্রযুক্তি অমদানি করেছে, যা বেআইনি। দ্বিতীয়ত, তারা মুভেবল ডিভাইস বাজারে অফার করছে। এর কী নিশ্চয়তা আছে যে, আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে আমাদের মতো সেবা দেবে না। আমরা শত কোটি টাকা দিয়ে লাইসেন্স নিয়ে অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। অন্যদিকে নামমাত্র মূল্যে আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের মতো সেবা দিতে যাচ্ছে। আমাদের আপত্তির বিষয়টি এরই মধ্যে চিঠি দিয়ে বিটিআরসিকে জানিয়েছি। যদি আমরা এর কোনো যুক্তিসঙ্গত প্রতিকার না পাই, তবে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া কোনো পথ খোলা থাকবে না।’
মাল্টিনেট গ্রুপের পণ্য ব্যবস্থাপক এমকে পাশা খান বলেন, ‘আমরা তারবিহীন ইন্টারনেটের যে সেবা দিতে যাচ্ছি, তা দেশের গ্রাহকের ব্যবহারের কথা মাথায় রেখে সাজানো হয়েছে। আমাদের কাছ থেকে দ্রুতগতির উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা পাবে গ্রাহক। এ ধরনের প্রযুক্তি বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা প্রদানে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে। পাঁচ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসার পরিসর বাড়ানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। প্রথমে রাজধানী, পরে দেশের অন্যান্য জেলা ও উপজেলায় ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিআরসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওয়াইম্যাক্স প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতার দৌড়ে ভয় পাচ্ছে কেন? ওয়াইম্যাক্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা ইন্টারনেট ব্যবসা প্রসার এবং নতুন অফার তৈরির সব ধরনের সুযোগ দিয়ে রেখেছি। বর্তমানে তাদের ৩৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ব্যবহারের অনুমতি আছে। আর আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমতি দেয়া হয়েছে মাত্র ৭ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ব্যবহারের। ওয়াইম্যাক্স প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে উড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু বাজারে আসার এত দিনেও ওয়াইম্যাক্স প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ মানুষকে কতটুকু সেবা দিতে পেরেছে, তা খতিয়ে দেখার বিষয়। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রতিদিনই নতুন কিছু আবিষ্কার হচ্ছে। শুধু ওয়াইম্যাক্সের স্বার্থের কথা চিন্তা করে দেশে নতুন প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ আসাকে আমরা বাধা দিতে পারি না। তাদের সুযোগ রয়েছে আরও ভালো করার। ওয়াইম্যাক্স ভালো করবে, তারপর আমরা দেশে প্রযুক্তি আসতে দেব, তা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। বৃহৎ স্বার্থ দেখলে এতে সাধারণ জনগণ আরও কম দামে দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাবে।’
ফিক্সড ওয়াইম্যাক্সের বিষয়ে বিটিআরসির সিদ্ধান্তকে অনৈতিক বলে জানান অজের ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড লিমিটেডের (কিউবি) প্রধান বিপণন কর্মকর্তা নেহাল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বিটিআরসি হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আমরা তাদের সম্মান করি। তাদের এ ধরনের পদক্ষেপ সুস্থ ধারার প্রতিযোগিতা তৈরি করবে না, যা আমাদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে না। আমরা এত টাকা খরচ করে লাইসেন্স নিয়েছি। আর বিনা লাইসেন্সে আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে আমাদের সঙ্গে প্রায় একই সুবিধা নিয়ে আসবে, তা কাম্য নয়। কিন্তু বিটিআরসি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলে আমাদের কিছু করার নেই। নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে আমরা বিটিআরসিকে মৌখিক আপত্তি জানিয়েছি।’
ওয়াইম্যাক্স প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ প্রসঙ্গে বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) জিয়া আহমেদ বলেন, কয়েকটি আইএসপিকে আগে থেকেই তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া ছিল। প্রতিষ্ঠানগুলোকে মবিলিটি ডিজেবল করার শর্তে ‘আইইইই ৮০২ দশমিক ১৬ই’ বেজস্টেশন ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। কারণ এর আগে দেশের আইএসপিগুলোকে তারবিহীন ইন্টারনেট সেবা দেয়ার জন্য ‘আইইইই ৮০২ দশমিক ১৬ডি’ বেজস্টেশন ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এ সিরিজের বেজস্টেশনের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ অনুমতি দেয়া হয়েছে। আর আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর মবিলিটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেবে বিটিআরসি।
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে তারবিহীন ইন্টারনেটের প্রসার পেলে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাত্রাও বাড়বে। সাশ্রয়ী দামে মানুষের দোরগোড়ায় ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়া যাবে। তাই নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাগত জানানো উচিত। কিন্তু এটাও সত্যি, আইএসপি লাইসেন্সের আওতায় তারবিহীন ইন্টারনেট সেবা দেয়ার সুযোগ করে দিলে বড় ধরনের অস্তিত্বসংকটে পড়বে ওয়াইম্যাক্স প্রতিষ্ঠান দুটি। কারণ তারা প্রায় ২১৫ কোটি টাকা খরচ করে সেবা দেয়ার অনুমতি পায়। আর মাত্র ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায় প্রায় কাছাকাছি ধরনের সেবা প্রদানের সুযোগ করে দেয়া আসলে কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা বিবেচনা করে দেখা দরকার নিয়ন্ত্রক সংস্থার।
মেজর (অব.) আবদুল মান্নান এ অসম প্রতিযোগিতা সম্পর্কে বলেন, বর্তমানে গড়ে এক হাজার টাকায় ২৫৬ কিলোবাইট গতি দিচ্ছে ওয়াইম্যাক্স প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের বাজার নষ্ট করার জন্য যদি ফিক্সড ওয়াইম্যাক্সের আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো একই দামে ৫১২ কিলোবাইটের তারবিহীন সেবা দেয়, তবে সাধারণভাবেই ব্যবহারকারীরা ফিক্সড ওয়াইম্যাক্সের দিকেই যাবে। কারণ যেহেতু ফিক্সড ওয়াইম্যাক্সের আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স ফি কম, তাই কিছুদিন লোকসান দিয়েও যদি তারা বাজার দখল করতে পারে, তাহলে বড় কোনো ক্ষতি নেই।
এ প্রসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুফি ফারুক ইবনে আবু বকর বলেন, ফিক্সড ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ডের সেবায় এসব প্রতিষ্ঠান আসার ফলে ফিক্সড ইন্টারনেটক্ষেত্রটি প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। এ ক্ষেত্রে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসার ঝুঁকি কমাতে বিটিআরসির ভূমিকা থাকা উচিত। একই সঙ্গে ওয়াইম্যাক্স প্রতিষ্ঠান দুটিরও ইন্টারনেট সেবার মবিলিটি বাড়াতে আরও বেশি জোর দেয়া উচিত।
বিটিআরসির সূত্রমতে, আইএসপি লাইসেন্সের আওতায় বর্তমানে দেশে মোট ১৫টি প্রতিষ্ঠানের তরঙ্গ (স্পেকট্রাম) ব্যবহারের অনুমতি আছে। প্রত্যেকে ৭ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ব্যবহার করতে পারে। এর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান কেডিডিআইয়ের ব্র্যাক বিডি মেইল, লিংক থ্রি, আমরা নেটওয়্যার্ক, বেক্সিমকো গ্রুপের বেক্সিমকো, স্কয়ার ইনফরমেটিকস, অগ্নি সিস্টেমস, এডিএন এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অলওয়েজ অন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ লিমিটেড অন্যতম।
সম্প্রতি মাল্টিনেট গ্রুপের ওলো আগ্রাসী বিপণনের কারণে আলোচিত হয়। ওলো তারবিহীন ইন্টারনেটে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন দ্রুতগতির সার্ভিসের অফার নিয়ে এসেছে। রাশিয়াভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বে অন্যান্য দেশে সেবার মান নিশ্চিত করার সুনাম রয়েছে। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ছোট পরিসরে পরীক্ষামূলকভাবে তাদের সেবা দেয়া শুরু করেছে। গত মাসের ২৫ তারিখ থেকে মাল্টিনেট প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহক পর্যায়ে তাদের বিপণন শুরু করে। এ মাসের ২০-২২ তারিখের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসা শুরুর ঘোষণায় যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
মোবাইল ও ফিক্সড ওয়াইম্যাক্সের পার্থক্য: মোবাইল ওয়াইম্যাক্স ব্যবহারকারী কোনো ধরনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছাড়া এক টাওয়ার থেকে অন্য টাওয়ারের আওতায় যেতে পারেন। কিন্তু ফিক্সড ওয়াইম্যাক্সের ব্যবহারকারীরা এক টাওয়ার থেকে অন্য টাওয়ারে যতবার যাবেন, ততবার তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে ব্যবহূত ডিভাইসটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন সিগন্যাল খুঁজে টাওয়ারের সঙ্গে যুক্ত হয়।
18/12/11 @ বণিক বার্তা

- Copyright © 2013 telecom bd - Metrominimalist - Powered by Blogger - Designed by Johanes Djogan | Distributed by Rocking Templates -