দেশের পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্তে দুই থেকে ৬ কিলোমিটারের মধ্যে মিলছে ভারতের তিনটি মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক। হিলি স্থলবন্দরসহ সীমান্তবর্তী অনেক এলাকায় ভারতীয় মোবাইল ফোনেই স্থানীয়রা বেশি কথা বলেন। এসব এলাকায় বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরের সংযোগ মিললেও নেটওয়ার্ক হয়ে পড়ে দুর্বল। আবার কোথাও কোথাও ভারতীয় অপারেটরগুলোর নেটওয়ার্ক এবং স্পেকট্রামের মধ্যেও সাংঘর্ষিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, বাংলাদেশের মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর নেটওয়ার্কই তাদের দেশের অভ্যন্তরে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত রয়েছে। স্পেকট্রামের সাংঘর্ষিক প্রতিক্রিয়ার (ইন্টারফেয়ারেন্স) কথা জানিয়েছে তারা। বিজিবির মাধ্যমে এমন অভিযোগ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশি অপারেটররাও সীমান্তে ভারতীয় মোবাইল ফোনের ইন্টারফেয়ারেন্স পায়। বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করতে গ্রামীণফোন ও রবি সীমান্তে টেকনিক্যাল জরিপও করে। তাতে তিনটি ভারতীয় মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্কে সীমান্ত এলাকায় গ্রামীণফোন ও রবির নেটওয়ার্কের সমস্যা ধরা পড়ে।
ভারতের বিএসএনএল ও রিলায়েন্সের স্পেকট্রামের কারণে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোয় রবির স্পেকট্রামে সমস্যা হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের স্পেকট্রামের সমস্যা বাড়াচ্ছে ভারতের ভোডাফোনের স্পেকট্রাম। পরে গ্রামীণফোন ও রবি বিটিআরসির কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করে। অপারেটর দুটি বিটিআরসিতে দেওয়া তাদের প্রতিবেদনের সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকার ফিল্ড

সার্ভেও জমা দেয়। এ নিয়ে বিটিআরসি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে।
বিটিআরসি বলছে, সীমান্তবর্তী এলাকায় টাওয়ার বা বেস স্টেশন নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো দেশের মোবাইল ফোন অপারেটরই নিয়ম মানে না। দু'দেশেই সীমান্তের খুব কাছাকাছি টাওয়ার স্থাপন করা হয়। সে কারণে সমস্যা বেশি হচ্ছে।
বিটিআরসিতে জমা দেওয়া গ্রামীণফোনের প্রতিবেদনে জানা গেছে, দিনাজপুরের হিলি সীমান্তে ৫ দশমিক ৮ কিলোমিটারের ভেতরে ভারতীয় ভোডাফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। সহজেই সীমান্তের এ দূরত্বের মধ্যে থেকে ভোডাফোনের মাধ্যমে কথা বলা যায়। তাছাড়া এ দূরত্ব পর্যন্ত ভোডাফোনের স্পেকট্রামের সঙ্গে গ্রামীণফোনের স্পেকট্রামে সমস্যা হয়। একই অপারেটরের মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর ও নওগাঁর কয়েকটি এলাকায় সাড়ে চার কিলোমিটার পর্যন্ত নেটওয়ার্ক বিঘি্নত হয়। কুষ্টিয়ার প্রাগপুর ও সীমান্তের ভেতর চার কিলোমিটারের বেশি এলাকায় ভোডাফোনের সংযোগ মেলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ এলাকায় তিন কিলোমিটারের মধ্যে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। এ ছাড়া সাতক্ষীরার দেবহাটা বা পঞ্চগড়ের অনেক এলাকায়ও একই সমস্যার কথা উল্লেখ করেছে গ্রামীণফোন।
একইভাবে রবির নেটওয়ার্কেও সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় ইন্টারফেয়ারেন্স হয়। তবে পশ্চিম দিকের সীমান্তে এ সমস্যা বেশি হলেও সিলেট বা কুমিল্লার দিকে সমস্যা তেমন নেই। অপারেটররা জানিয়েছেন, সীমান্তের অনেক এলাকায় দু'দিকের মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক এমন হয়ে গেছে যে, একটি অন্যটির ওপর ওভার ল্যাপ করে। এ ছাড়া দুই প্রতিবেশী দেশের অপারেটররা একই ব্র্যান্ডের স্পেকট্রাম ব্যবহার করায়ও সমস্যা জটিল হয়।
এ সমস্যার কারণে কখনও কখনও সীমান্তবর্তী এলাকায় দেশি মোবাইলে কথা বললেও সেটি ভারতীয় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক হয়ে আসে। যার কারণে সেটি রোমিং কল হিসেবে বিবেচিত হয়। গত বছরই সরকারের এক মন্ত্রী দেশের বাইরে না গিয়েও এক মাসের মোবাইল বিল দেখে চমকে ওঠেন। পরে তিনি অভিযোগ করলে জানা যায়, তিনি সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরা এলাকায় গিয়ে তার গ্রামীণফোনের সিম ব্যবহার করেছেন। ওই এলাকায় বসে যত কথা বলেছেন, সবই রোমিং কল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
সূত্র জানায়, কিছুদিন আগ পর্যন্ত দু'দেশের সীমান্তের বেশ দূরেই বিটিএস বসানোর অনুমোদন ছিল। ভারতীয় সীমান্তের ১০ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশে ৮ কিলোমিটার দূরে বিটিএস বসানো হতো। ভারত এ নিয়ম শিথিল করে সীমান্তের একেবারে কাছে চলে আসে। পরে বিটিআরসিও নীতিমালা শিথিল করে সীমান্তের এক কিলোমিটারের মধ্যে বিটিএস বসানোর অনুমোদন দেয়। এ নিয়মও মানা হচ্ছে না। দেশের অন্তত ১০টি সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সীমান্ত ঘেঁষে টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। ফলে সহজেই ভারতীয় সীমান্তে বসেই এ দেশের মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়, যার কারণে চোরাচালানের ক্ষেত্রেও এ সংযোগ ব্যবহার হয়। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় যাওয়া বাংলাদেশিদের অনেকেই জানিয়েছেন, ভারতের সীমান্ত থেকে অন্তত দুই কিলোমিটার ভেতর পর্যন্ত সহজেই গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবিসহ অন্যান্য অপারেটরের সংযোগ মেলে। তবে সবচেয়ে বেশি সংযোগ পাওয়া যায় এয়ারটেল সিমের সাহায্যে।
এসব বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান জিয়া আহমেদ সমকালকে বলেন, ভারতীয় মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো নানাভাবে সীমান্তের ওপর প্রভাব বিস্তার করছিল। সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করতেই এখান থেকেও সীমান্তের আরও কাছাকাছি বিটিএস নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে কারণে স্পেকট্রামের ওপর কিছু প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক নয়। তিনি বলেন, তারা এগিয়ে আসবে আর আমরা তাদের সুযোগ করে দেব, তেমনটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই।
সমস্যা সম্পর্কে গ্রামীণফোনের করপোরেট বিভাগের প্রধান মাহমুদ হোসাইন স্বীকার করেন, অনেক দিন থেকে এমন সমস্যা রয়েছে। একই সঙ্গে তিনি প্রত্যাশা করেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
রোমিংবিহীন ওপারের এয়ারটেল সিম চলে ঢাকায় : রোমিং না করা হলেও ভারত থেকে কেনা এয়ারটেলের সিম ঢাকায় ব্যবহৃত হচ্ছে। দু'দেশেরই একই কোম্পানির অপারেটর থাকায় হরহামেশাই এমনটি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি। অন্যদিকে আবার বাংলাদেশের এয়ারটেল সিম দিয়ে সহজেই ভারতের এয়ারটেলে কথা বলার ঘটনা ঘটেছে,। বিল হচ্ছে লোকাল বিলের মতোই। তবে এমন ঘটনার কথা এয়ারটেলের কারও জানা নেই বলে জানিয়েছেন অপারেটরটির এক শীর্ষ কর্মকর্তা।রাজশাহীর বিস্তৃত সীমান্ত অঞ্চলের মানুষ অবাধে ব্যবহার করছে ভারতীয় মোবাইল অপারেটরের সংযোগ। সীমান্তের তিন কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত অন্তত ২০টি গ্রাম ও একটি উপজেলা সদরে ভারতের এয়ারটেল ও ভোডাফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় অনায়াসে। ঘর থেকে বেরিয়ে একটু ফাঁকা স্থানে গেলে নেটওয়ার্ক মেলে অন্তত আরও ৮ থেকে ১০ গ্রামে। এমনকি রাজশাহী মহানগরীতেও পদ্মার পাড় থেকে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।
রাজশাহীর সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গ্রামে সরেজমিন দেখা গেছে, সীমান্তের দেড় থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত গ্রামগুলোর প্রতিটি বাড়িতেই ভারতীয় সিমকার্ড রয়েছে। তাদের সবার কাছে এ দেশের অপারেটরের একাধিক সিম রয়েছে। সেগুলোই সেটে ভরে রাখা হয়। ভারতীয় সিমকার্ড আলাদা করে রেখে দেওয়া হয়। ভারতে কথা বলার প্রয়োজন হলে সেগুলো ব্যবহার করা হয়।
গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাঢ়িয়াদহ গ্রামের শহীদুল ইসলাম জানান, তাদের গ্রামের কয়েকশ' মানুষ ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলা ও লালগোলা থানার বিভিন্ন এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতে যান। কাজ শেষে ফিরে আসার পর আবার নতুন কাজ পাওয়ার জন্য প্রতিদিনই তাদের মোবাইল ফোনে কথা বলতে হয়। এ ক্ষেত্রে সীমান্তবর্তী গ্রামটির মানুষ বাংলাদেশের কোনো মোবাইল অপারেটরের ফোন ব্যবহার করেন না। তারা কথা বলেন ভারতের অপারেটরের নম্বর থেকে। অল্প বিলে কথা বলা যায়, সে কারণেই তারা এমনটি করেন বলে দাবি শহীদুলের।
আষাঢ়িয়াদহ ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হজরত আলীও ভারতীয় মোবাইল সিম ব্যবহার করে বিভিন্ন সময় সীমান্তের ওপারে তার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, তাদের এলাকার সবারই ওপারে আত্মীয়স্বজন রয়েছে। বেশিরভাগই তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কম টাকায় কথা বলার জন্য এ পথ বেছে নিয়েছেন। তাদের এলাকায় এয়ারটেল ও ভোডাফোনের ব্যবহারই

বেশি। তিনি জানান, ভারতীয় সংযোগে ওপারে কথা বললে দিনে প্রতি মিনিট এক টাকা আর রাতে ৫০ পয়সা করে খরচ পড়ে। সেখানে এ দেশের সংযোগে কথা বলতে খরচ পড়ে মিনিটে ১০ টাকা। খরচ কমাতেই তারা এ পথ বেছে নিয়েছেন বলে হজরত জানান।
শুধু চরআষাঢ়িয়াদহই নয়, আশপাশের দিয়ার মানিকচক, সাহেবনগর, কোদালকাটি, আলতুলি ও বকচরের হাজার তিনেক মানুষ প্রতিদিনই ভারতীয় মোবাইলে কথা বলেন। এ গ্রামগুলো পদ্মার ওপারে। এসব গ্রামের সীমানা শেষ হলেই শুরু হয় ভারতের এলাকা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারতের টেলিকম অপারেটরদের বিটিএস তাদের গ্রাম থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে হওয়ায় এত সহজে মেলে নেটওয়ার্ক।
ভারতীয় কোম্পানির সে টাওয়ারটি গোদাগাড়ী উপজেলা সদরে পদ্মার পাড়ে দাঁড়ালে স্পষ্টই দেখা যায়। স্থানীয়দের ধারণা, পদ্মার পাড় থেকে টাওয়ারটির দূরত্ব হতে পারে সর্বোচ্চ ৪ কিলোমিটার। সেখানকার বিটিএসটির কল্যাণে পদ্মার এ পাড়ে গোদাগাড়ীর মাদারপুর, মহিষালবাড়ী, ডাইংপাড়া, হাটপাড়া ও সুলতানগঞ্জ এলাকা থেকেও পূর্ণ নেটওয়ার্কে কথা বলা যায় ভারতের এয়ারটেল ও ভোডাফোনের সিম থেকে। ওই এলাকার একাধিক অধিবাসী জানান, বৈধপথে সিমকার্ড আনতে দেওয়া হয় না। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ সিম লুকিয়ে নিয়ে আসা হয়। টাকা শেষ হয়ে গেলে ওপার থেকেই আত্মীয় কিংবা ব্যবসায়িক পার্টনাররা লোড করে দেন। কাজকর্ম কিংবা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি ওই এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিদের হাতেও ভারতীয় সিম রয়েছে।
রাজশাহী মহানগরীর বড়কুঠি ও আলুপট্টি এলাকায় পদ্মার পাড় থেকে এয়ারটেল ও ভোডাফোনের সিম ব্যবহার করে কথা বলেন অনেকেই। তাদের বেশিরভাগই ভারতে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলেন বলে জানান। মালদা এলাকায় আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলেন এমন একজন জানান, কম খরচে কথা বলা যায় বলেই তারা এভাবে কথা বলেন। বিষয়টি বেআইনি হলেও এ নিয়ে খুব একটা তোড়জোড় না থাকায় অনেকেই এ কাজ করছেন বলেও তার ধারণা।
বাঘা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতেও একই চিত্র দেখা গেছে। পাকুড়িয়া ইউনিয়নের নদী-তীরবর্তী বকুলপুর, মালিয়ানদহ, কিশোরপুর ও মীরগঞ্জের রাওথা এলাকার অধিবাসীরা ঘর থেকেই ভোডাফোনে কথা বলতে পারেন।

- Copyright © 2013 telecom bd - Metrominimalist - Powered by Blogger - Designed by Johanes Djogan | Distributed by Rocking Templates -